জানুয়ারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি : প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশের অর্থনীতিঃ আমাদের রোল মডেল কারা?

জুলফিকার আলী : শুরুতেই বলে রাখি পুরো লেখা আমার ব্যক্তিগত ধারণা এবং অনুভূতির প্রকাশ মাত্র। এটা অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে না ও হতে পারে। তবে আমি বিশ্বাস করি আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এসব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন খুব সম্ভব।
পর্বঃ ১ ( পর্যটন শিল্প )
এক.
পৃথিবীর সকল দেশের অর্থনীতির ভিত্তি এক নয়। একেক দেশের অর্থনীতি একেক সেক্টরের উপর নির্ভরশীল হতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হল কৃষি খাত,সার্ভিস, বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টর এবং রেমিট্যান্স ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম মূল ভিত্তি হতে পারতো যে পর্যটন খাত সেটাকেই আমরা তেমন গুরুত্ব দিই না। এর অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত যারা পর্যটকদের একটা বড় অংশকেই নিজেদের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তবে আমাদের এই তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্যেই লড়াই করে টিকে থাকতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন স্মার্ট ও সঠিক পরিকল্পনা এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের বাস্তবায়ন।
দুই.
পর্যটন খাত থেকে আমাদের বার্ষিক আয় নিতান্তই কম, মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার যা জিডিপির পার্সেন্টেজের দিক দিয়ে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। যেখানে মালদ্বীপের মতো পুঁচকে দেশ বছরে ২.৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে যা তাদের জিডিপির ৪৪ শতাংশ, সেখানে আমাদের আয়কৃত বার্ষিক ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার কিছুই নয়। ১৯৫ টা স্বাধীন দেশের মধ্যে পর্যটন শিল্পে আমাদের অবস্থান ১৪০ এর কাছাকাছি যা মোটেই সুখকর নয়। আমাদের প্রায় সমান বা কাছাকাছি অর্থনীতির কিছু দেশের পর্যটন খাত থেকে ২০১৮ সালের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ তুলে ধরছিঃ
থাইল্যান্ড ৬০ বিলিয়ন ( মোট অর্থনীতির প্রায় ১২ শতাংশ ) ,মালয়েশিয়া ১৮.৩২ বিলিয়ন, ইন্দোনেশিয়া ১২.৫২ বিলিয়ন, ভিয়েতনাম ৮.৯ বিলিয়ন,ফিলিপাইন ৭ বিলিয়ন, শ্রীলংকা ৩.৯২ বিলিয়ন, পেরু ৩.৭১ বিলিয়ন, কম্বোডিয়া ৩.৬৩ বিলিয়ন, নাইজেরিয়া ২.৫৫ বিলিয়ন,ইরাক ২.৪২ বিলিয়ন,তাঞ্জানিয়া ২.৩৩ বিলিয়ন, মিয়ানমার ২.৩ বিলিয়ন, ইয়েমেন ১.২ বিলিয়ন, সুদান ১.০৩ বিলিয়ন, কেনিয়া ৯২.৬ কোটি, উগান্ডা ৯২ কোটি, জিম্বাবুয়ে ৮৯ কোটি মার্কিন ডলার।
তিন.
প্রথমেই আমাদের পর্যটন শিল্পের বাধার কারণগুলো খতিয়ে দেখা যাক। বাংলাদেশের পর্যটকদের অনাগ্রহের অন্যতম প্রধান কারণ হলো নিরাপত্তার অভাব,খাদ্যে ভেজাল,বিশ্বস্ত ট্যুর গাইডের অভাব, ট্যুরিস্ট স্ক্যাম, বাজে রাস্তাঘাট,ভাষাগত সমস্যা, দুর্বল অবকাঠামো, সুযোগ সুবিধার অভাব এবং বিনোদনের সরঞ্জামের অপ্রতুলতা ইত্যাদি। যাতায়াতের সুব্যবস্থা না থাকায় কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এখনো পর্যটকদের কাছে দুর্গম বলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা বেশি বলে অনেকে বলে থাকেন। কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকতে গোসলে গিয়ে এজন্য অনেকেই বিপদে পড়েন ও প্রাণ হারান। কাজেই স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া পর্যটন শিল্প বিকাশের কথা ভাবাই ঠিক না।
বহির্বিশ্বের মিডিয়াগুলোতে বাংলাদেশকে প্রচার করা হয় দারিদ্র্য,দুর্নীতি,অসৎ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার দেশ হিসেবে। এদিক থেকে আমাদের দেশ ভ্রমণে পর্যটকদের নিরুৎসাহিত হবার যথেষ্ট কারণ আছে। যেখানে পর্যটকেরা সচ্ছলতা, শান্ত ও নিরুদ্বিগ্ন পরিবেশ চায়, সেখানে আমাদের মতো অশান্ত এবং উদ্বেগপূর্ণ দেশে কে ই বা আসতে চায়!
চার.
এবার পর্যটন শিল্পের সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়ে কথা বলা যাক।
(১) পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে প্রথমেই আমাদের দেশে যেটা প্রয়োজন সেটা হল পর্যটকদের জন্য নিরাপদ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা। আমরা জাতিগতভাবে অসভ্য কিংবা বর্বর নই। তাই বিদেশী পর্যটকদের জন্য নিরাপদ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা খুব জটিল কোনো কাজ নয়। এর জন্য চাই শুধু সদ্ভাব এবং ইতিবাচক মানসিকতা। তাঁদের অযথা বিরক্ত না করা,বিভিন্ন প্রয়োজনে সাহায্য করা এবং হাসিমুখে কথা বলা এটুকুই আমাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা জন্ম দিতে যথেষ্ট। সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
(২) পর্যটনকেন্দ্রগুলো হরতাল অবরোধসহ বিভিন্ন সহিংসতার আওতা মুক্ত করতে হবে। আমরা নিজেদের মধ্যে যতটা কামড়াকামড়ি করি না কেন বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিতে হবে।
(২) পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ভেজালমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
(৩) আমাদের মনে রাখতে হবে যে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র ছেড়ে কোনো কোটিপতি এদেশে ঘুরতে আসবে না। বিদেশি পর্যটকদের একটা বড় অংশই তাঁদের আয় থেকে জমানো অর্থে ভ্রমণ করতে আসেন। তাই তাঁদের টাকার গাছ মনে করে ডাকাতি (অধিক অর্থ আদায় করার চেষ্টা যা এক বড় ধরনের ট্যূরিস্ট স্ক্যাম হিসেবে গণ্য করা যায়) করার চেষ্টা করা যাবে না। বরং সালামি পদ্ধতিতে একটু একটু করে টাকা আদায় করতে হবে। এতে বিদেশি পর্যটকরা এদেশে আসতে আগ্রহী হবে।
(৪) বিশ্বস্ত ট্যুর গাইডের ব্যবস্থা করতে হবে যারা চুক্তি অনুযায়ী পর্যটকদের ইচ্ছা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখাবে।
(৫) সড়ক,নৌ এবং আকাশপথে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ গাড়িচালনা থেকে বিরত থাকতে হবে। সম্প্রতি বান্দরবানসহ দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে নতুন পাকা রাস্তাঘাট তৈরি করা হয়েছে। কুয়াকাটাসহ অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রেও নিরাপদ এবং উন্নয়ন যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
(৬) পর্যটনকেন্দ্রের নিকটবর্তী চালক বা দোকানীদের ইংরেজি ভাষা শেখানো অতটা সহজ কথা নয়। তাই তাদের গুগল ট্রান্সলেটর ব্যবহার করে কথোপকথনের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
(৭) বিনোদনের সরঞ্জাম এবং সার্বিক সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে। সকল পর্যটন এলাকায় ভালো মানের আবাসিক হোটেল বা কটেজের ব্যবস্থা করতে হবে। এসবের দর্শন যা ই হোক না কেন গুণ বা সার্ভিস ভালো হতে হবে।
(৮) ইতিহাস এবং সংস্কৃতির সাথে সভ্যতার মেলবন্ধন ব্যাখ্যার মাধ্যমে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে হবে৷ উদাহরণস্বরূপ দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুর দোকানগুলোতে ইনকা সভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কিত বিভিন্ন তৈজসপত্র স্যুভেনির বা নিদর্শন হিসেবে বিক্রি করা হয়। এতে সাধারণ কোনো তৈজসপত্র পর্যটকরা না কিনলেও ইতিহাস সম্পর্কিত জিনিসপত্র কিনতে আগ্রহী হয়।
(৯) এ ছাড়া যে সব স্থানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, সেগুলোর সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতা বজায় রাখা আবশ্যক। একই সঙ্গে দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানে সময়োচিত বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে পর্যটন শিল্প বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা উচিত।
(১০) পার্বত্য জেলাগুলো এবং কক্সবাজার আমাদের সামনে দারুণ সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে। কাজেই এ অঞ্চল রিফিউজিদের স্থায়ী আবাসস্থল হতে পারে না। শ্রীঘ্রই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে এবং উপজাতি জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে।
(১১) সর্বোপরি বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ এবং অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ হিসেবে তুলে ধরতে হবে। সবাইকে নিজেদের অবস্থান থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিংবা ইউটিউব যেখানেই হোক বাংলাদেশের সৌন্দর্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরতে হবে। আশা করি এর মাধ্যমে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিশ্বে সম্মানজনক স্থান লাভ করবে।
পাঁচ.
পরিশেষে বলতে চাই, পর্যটন শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে আমাদের দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এতে যেমন বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে তেমনি আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। অপরদিকে বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশীদের সম্পর্কে ধারণা আরো ভালো হবে। এদেশের মানুষকে আরও সভ্য করার চেষ্টা পর্যটন কেন্দ্রের মতো ক্ষুদ্র এলাকা থেকেই শুরু হোক!
বিঃদ্রঃ লেখার কোনো অংশে ভুল থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।